১৩ জুলাই ২০২৫ - ২০:৩৪
গ্রোসির আচরণ কি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার জন্য বৈধতার সংকট সৃষ্টি করেছে?

আন্তর্জাতিক পরমানুষ শক্তি সংস্থা বা আইএইএ ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি সম্পর্কে নানা ধরনের বিদ্বেষী রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এছাড়াও সংস্থাটি সম্প্রতি ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর উপর মার্কিন হামলার বিষয়েও নীরব থেকেছে। ইসলামী ইরান আইএইএ'র এইসব রিপোর্টের সুনির্দিষ্ট ও প্রতিরোধমূলক জবাব দেয়ায় পাশ্চাত্যের মিডিয়ার খেলা ও গ্রোসির পথ চলা চ্যালেঞ্জের শিকার হয়েছে।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): পার্সটুডে সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী:আন্তর্জাতিক পরমানুষ শক্তি সংস্থা বা আইএইএ  ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি সম্পর্কে নানা ধরনের বিদ্বেষী রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এছাড়াও সংস্থাটি সম্প্রতি ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর উপর মার্কিন হামলার বিষয়েও নীরব থেকেছে। ইসলামী ইরান আইএইএ'র এইসব রিপোর্টের সুনির্দিষ্ট ও প্রতিরোধমূলক জবাব দেয়ায় পাশ্চাত্যের মিডিয়ার খেলা ও গ্রোসির পথ চলা চ্যালেঞ্জের শিকার হয়েছে।


আই এ ই এর দায়িত্ব হল শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচির বিষয়ে নজরদারি করা প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনা প্রবাহের দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায় রাফায়েল গ্রোসির নেতৃত্বাধীন এই নজরদারি সংস্থা প্রযুক্তিগত স্বচ্ছ ব্যাখ্যা দেয়ার পরিবর্তে ইরানের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগের রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

দ্বিমুখী আচরণ, অনির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রগুলোর উপর পক্ষপাতমূলক নির্ভরতা, পরস্পর বিরোধী রিপোর্ট  এবং পরিশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইহুদিবাদি ইসরাইলের বিদ্বেষী আচরণের অনুকূলে মিডিয়ায় প্রচারণাগত পটভূমি সৃষ্টি গ্রোসির রেকর্ডকে তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। 

ইসলামি ইরান এ অবস্থায় কেবল নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকেনি। দেশটি আইনি কূটনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা ব্যবহার করে এই রাজনৈতিক খেলার উপযুক্ত ও চৌকস জবাব দিয়েছে।  

ইরানের জবাব ছিল বৈধনিখুঁত ও প্রতিরোধমূলক  

ইরানের বিষয়ে জাতিসংঘের পরমাণু বিষয়ক নজরদারি সংস্থা আইএইএ এর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসির ইরান বিরোধী ও পক্ষপাত মূলক নানা আচরণ বারবার দেখে আসছেন ইরানিরা, তাই তারা ইরানে গ্রোসির প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গ্রোসি যে কেবল নিরপেক্ষ আচরণ দেখাতেই ব্যর্থ হয়েছেন তা নয় ইরান সম্পর্কে তাঁর সংস্থার রিপোর্টগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের আগেই গোপনে সেসবের বিষয়বস্তু চলে যেত পশ্চিমা ও ইহুদীবাদী সংবাদ মাধ্যমগুলোতে। আর এ থেকেই বোঝা যায় গ্রোসি ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। তিনি মোটেই নিরপেক্ষ কারিগরি খাতের ব্যক্তিত্ব নন। তাই চুক্তির একটি পক্ষ তথা চুক্তির অন্যতম শরিক একটি দেশের বিরুদ্ধে নিরাপত্তাগত সংকট সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছেন বলেই এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি প্রচলিত বিষয় যার অনেক নজির রয়েছে।

অবশেষে ইরান নিজের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কথা ভেবে পরমাণু নজরদারি সংস্থার পক্ষ থেকে গোপন তথ্য ফাঁস করা ও  উত্তেজনামূলক পদক্ষেপ নেয়ার প্রেক্ষাপটে এই সংস্থার বিশেষ কয়েকজন পরিদর্শকের পরিদর্শনকে স্থগিত বা সীমাবদ্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছে। আর এই সিদ্ধান্ত সংস্থাটির সেইফগার্ড আইন ও সংস্থাটির গঠনতন্ত্রের নয় নম্বর ধারা বিশেষ করে পরিদর্শকদের আসল পরিচয় প্রকাশের ধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। 

 আই এ ই এ কিভাবে ইরানে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে

১.কারিগরি বাছাই প্রক্রিয়া ছাড়াই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত রিপোর্টগুলো প্রকাশ করা

কারিগরি প্রক্রিয়া থেকে এই সংস্থার বিচ্যুতির অন্যতম প্রমাণ হলো সংস্থাটি নিজের সুরক্ষার বিধিমালা ও বৈজ্ঞানিক বাছাই প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে অনির্ভরযোগ্য ও অনিরপেক্ষ নানা সূত্র থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছে। বিশেষ করে ইহুদীবাদী ইসরাইলের কাছ থেকে নানা মিথ্যা তথ্য নিয়েছে এই সংস্থা। যেমন মারিভান ও আরো একটি অঞ্চলে ইউরেনিয়ামের কণা পাওয়া গেছে- এমন তথ্য সংস্থাটির রিপোর্টে যুক্ত করা হয় যা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং এই তথ্য প্রচার করেছে সর্বপ্রথম ইহুদিবাদী ইজরায়েল। কোন ধরনের সরেজমিন তদন্ত ছাড়াই এই দাবি সরাসরি আইএইএ'র রিপোর্টে যুক্ত করা হয়

২.সামরিক হামলার পরিবেশ সৃষ্টি করা 

এই পরমাণু নজরদারি সংস্থাটি যেভাবে নানা ধরনের ইরান বিরোধী রিপোর্ট সাজিয়েছে এবং এর প্রধান যেসব শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করেছেন ইরানের বিরুদ্ধে দেশটির কয়েকটি পরমাণু স্থাপনায় ইসরাইলি ও মার্কিন সামরিক হামলার প্রাক্কালে তাতে এটা বোঝা যায় যে সংস্থাটি  কেবল প্রযুক্তিগত পরিদর্শক হিসেবে নয় একই সাথে সামরিক হামলার পটভূমি সৃষ্টিকারী হিসেবেও ভূমিকা রেখেছে।

৩.দ্বিমুখী আচরণ এবং ইরানের উপর আগ্রাসী হামলাকে উপেক্ষা করা

আইএইএ'র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতার আরেকটি বড় ও স্পষ্ট দৃষ্টান্ত হলো ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু স্থাপনাগুলোর উপর মার্কিন ও ইসরায়েলি হামলার ব্যাপারে পুরোপুরি নীরব থাকা। নাতানজ, ফোরদো ও ইস্পাহানের পরমাণু স্থাপনা গুলোতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রেক্ষাপটে আশা করা হচ্ছিল পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির সদস্য কোন দেশের পরমাণু স্থাপনায় হামলা এই সংস্থার নীতিমালার লঙ্ঘন বলে সংস্থাটি এজাতীয় হামলার তীব্র নিন্দা জানাবে, কিন্তু গ্রোসি তার বক্তব্যে এ বিষয়ে কোন নিন্দা জানাননি বরং তিনি ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে 'অত্যন্ত বিপজ্জনক' বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও সংস্থাটির সঙ্গে 'জরুরী সহযোগিতা অপরিহার্য'-এমন বাক্য ব্যবহার করে তিনি ইরানের পরমাণু স্থাপনার উপর পশ্চিমা হামলার বিষয়ে এক ধরনের বৈধতাই দান করেছেন। অথচ এই সংস্থার সংবিধান বা গঠনতন্ত্রের চতুর্থ ধারা বা অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংস্থাটির সদস্য দেশগুলোর শান্তিপূর্ণ পরমানু স্থাপনার উপর সম্ভাব্য হামলার হুমকি বা হামলার বিরুদ্ধে অত্যন্ত জোরালো অবস্থান নেয়া এই সংস্থার দায়িত্ব।

 রাজনৈতিক খেলা কি শেষ হয়ে আসছে

গ্রোসি পাঁচ বছর সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে পরমাণু নজরদারি সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

বর্তমানে এই সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা বা নির্ভরযোগ্যতা, নিরপেক্ষতা ও বৈধতা আর কখনো এতটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি। এই সংস্থাটির দায়িত্ব ছিল বিশ্বের দেশগুলোর শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচির ওপর প্রযুক্তিগত ও কারিগরি নজরদারি করা, কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের বহু দেশ বিশেষ করে ছোট নিরপেক্ষ সম্মেলনভুক্ত দেশগুলো এই সংস্থাটিকে ইজরায়েল ও পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে দেখছে।

নানা ধরনের রিপোর্টে বিভিন্ন অসত্য তথ্য প্রচার, গোপনীয় তথ্য ফাঁস করা, সামরিক আগ্রাসনের পক্ষ নেওয়া ও হুমকি দিয়ে কথা বলা- এসবই হচ্ছে এমন কিছু আচরণ যা এই সংস্থার পেশাগত অবস্থানকে খুবই দুর্বল করে ফেলেছে। এছাড়াও আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে নড়বড়ে অবস্থা, শান্তিপূর্ণ পরমানু স্থাপনাগুলোয় আগ্রাসনের ব্যাপারে দুর্বল অবস্থান নেয়া ও স্বাধীনভাবে বিশেষজ্ঞের ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হওয়া ইত্যাদি এ সংস্থাটিকে আন্তর্জাতিক নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ অভিভাবকের মর্যাদা থেকে নিচে নামিয়ে এনে একে স্বাধীন দেশগুলোর বিরুদ্ধে  রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। 

মনে হচ্ছে ইরানের বিরুদ্ধে গ্রোসির রাজনৈতিক খেলা শেষ হয়ে আসছে। বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাওয়া, আগ্রাসনের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয়তা ও পশ্চিমা চাপ প্রয়োগের সমন্বয়কের প্লাটফর্মে পরিণত হওয়া ইত্যাদি কারণে এই সংস্থাটি একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ এবং যোগ্য কারিগরি বিচারকের ভূমিকা পালনকারী হিসেবে কেবল তেহরানের কাছে নয় বিশ্বের এক বড় অংশের কাছেই মর্যাদা হারিয়েছে।  আর এ অবস্থা চলতে থাকলে চাপের শিকার দেশগুলো সংস্থাটির সঙ্গে সহযোগিতার মাত্রা কমিয়ে আনতে বাধ্য হবে ও সংস্থাটিকে বৈশ্বিক নজরদারির সংস্থা বলেই আর মনে করবে না, বরং একে এক অকার্যকর রাজনৈতিক খেলোয়াড় বলেই মনে করবে। তাই এটা স্পষ্ট ইরান তার সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলোতে কেবল নিজের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার পদক্ষেপই নেয়নি একইসঙ্গে বিশ্ব ব্যবস্থার কাঠামো গুলোর নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা শেষ হয়ে যাওয়ার  মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কেও সতর্কবার্তা তুলে ধরেছে।

Tags

Your Comment

You are replying to: .
captcha